মধ্যযুগে বাংলার রকমারি ক্ষুদ্র শিল্পের কথা জানা যায়। এ প্রসঙ্গে ধাতব শিল্পের কথা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য । তখন লৌহ নির্মিত দ্রব্যাদির ব্যাপক প্রচলন ছিল । কর্মকারগণ বিভিন্ন কৃষি যন্ত্রপাতি নির্মাণ করত । এছাড়া দু'ধারী তরবারি, ছুরি, কাঁচি, কোদাল ইত্যাদি নিত্যব্যবহার্য ধাতব দ্রব্য তৈরি হতো । কলকাতা ও কাশিম বাজারে এদেশের লোকেরা কামান তৈরি করত । কাগজ, গালিচা, ইস্পাত প্রভৃতি শিল্পের কথাও জানা যায় । বঙ্গের অন্যতম শিল্প হিসেবে লবণের কথাও জানা যায় । দেশে স্বর্ণকার সম্প্রদায় ছিল । বাঙালি কারিগরেরা স্বর্ণ, রৌপ্য, ব্রোঞ্জ, কাঠ, পাথর, গজদন্ত ইত্যাদির কাজ বিশেষ নিপুণতার সঙ্গে সম্পাদন করত । শঙ্খ শিল্পের জন্য ঢাকার প্রচুর সুখ্যাতি ছিল । ঢাকার শাঁখারীপট্টি আজও সেকথা স্মরণ করিয়ে দেয় ।
রপ্তানি দ্রব্য:
বাংলার কৃষি ও শিল্প পণ্যের প্রাচুর্য এবং বিদেশে এগুলোর ব্যাপক চাহিদার ফলে বিদেশের সঙ্গে বাংলার বাণিজ্যিক তৎপরতা মুসলমান শাসন আমলে অভূতপূর্ব প্রসার লাভ করেছিল । বাংলার রপ্তানি পণ্যের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল সুতি কাপড়, মসলিন, রেশমি বস্ত্র, চাল, চিনি, গুড়, আদা, লঙ্কা ইত্যাদি । কৃষিজাত পণ্যের মধ্যে চাল, তামাক, সুপারি, পাট, ফল ইত্যাদি রপ্তানি হতো । বিবিধ কৃষি ও শিল্পজাত দ্রব্য ছাড়াও বাংলা থেকে লবণ, গালা, আফিম, নানা প্রকার মসলা, ঔষধ ইত্যাদি ভারতবর্ষের বিভিন্ন স্থানে এবং বিভিন্ন দেশে পাঠানো হতো । তখন বাংলায় দাস ব্যবসাও প্রচলিত ছিল ।
আমদানি দ্রব্য:
ব্যবসা-বাণিজ্যের সিংহভাগই ছিল রপ্তানি নির্ভর। খুব অল্প পরিমাণ দ্রব্য আমদানি করা হতো । বাংলার কাপড়ের চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় কাঁচামাল হিসেবে তুলা আমদানি করা হতো। বাঙালি বণিকেরা গুজরাট থেকে আমদানি করত তুলা, চীন থেকে রেশম, ইরান থেকে শৌখিন দ্রব্য। এছাড়া বাংলায় আমদানি করা হতো স্বর্ণ, রৌপ্য ও মূল্যবান পাথর ।
বন্দর:
মুসলমান শাসনের সময় বাংলায় বেশ কিছু সমুদ্রবন্দর ও নদীবন্দর গড়ে উঠেছিল। চট্টগ্রাম ছিল তখনকার বিখ্যাত সমুদ্রবন্দর। উড়িষ্যা, সোনারগাঁ, গৌড়, বাকলা (বরিশাল), মুর্শিদাবাদ, কাশিমবাজার, হুগলি, বিহারের পাটনা ও উড়িষ্যার পিপলী উল্লেখযোগ্য বাণিজ্যবন্দর ছিল । ব্যবসা-বাণিজ্য বৃদ্ধি পাওয়ার সাথে সাথে দ্রব্য ও টাকা-পয়সার লেনদেন এবং হিসাব-নিকাশ বৃদ্ধি পায় । তাই ক্রমে ব্যাংকিং প্রথার বিকাশ ঘটে । এ যুগে হুন্ডির মাধ্যমে বিদেশে লেনদেন করা হতো। সমগ্র মধ্যযুগে বাংলায় দ্রব্যসামগ্রী সহজলভ্য ও সস্তা ছিল। চৌদ্দ শতকে বিখ্যাত ভ্রমণকারী ইবনে বতুতা লিখেছেন যে, সমগ্র পৃথিবীর মধ্যে বাংলাতেই সবচেয়ে সস্তায় জিনিসপত্র পাওয়া যেত । তারপরও সমসাময়িক সাহিত্য থেকে জানা যায়, দেশে ঐশ্বর্যশালী ধনীর পাশাপাশি প্রচুর দরিদ্র লোকও ছিল। তাই দ্রব্যসামগ্রী সস্তা হলেও তা সাধারণ কৃষক ও প্রজাদের সহজে কেনার সামর্থ্য ছিল না । বাংলার শিল্প, ব্যবসা-বাণিজ্য ও অন্যান্য অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে মুসলমান অপেক্ষা হিন্দুদের প্রাধান্য ছিল বেশি। ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে স্থানীয় ব্যবসায়ীদের কোনো কর্তৃত্ব ছিল না। এদেশের বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করত আরবীয় ও পারসিক বপিকেরা। নৌ-বাণিজ্যের একচেটিয়া কর্তৃত্ব ছিল তাদেরই। পরবর্তীকালে পর্তুগিজ ও অন্যান্য ইউরোপীয় বণিকরা ব্যবসার ক্ষেত্রে আধিপত্য বিস্তার করতে থাকে।
আরও দেখুন...